মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

গত ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও এনইসি চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা।  নেদারল্যান্ডসের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আলোকে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনাটি প্রণীত হয়েছে।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাংলাদেশ সরকারের একটি অনন্য ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ।  ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দলিল। একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত, কারিগরি ও আর্থসামাজিক দলিল এই পরিকল্পনা।

ঝুঁকি বিবেচনায় ছয়টি হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে এই পরিকল্পনায়। হটস্পট গুলো হচ্ছে— উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওড় ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল এবং নগরাঞ্চল। প্রতিটি হটস্পটে সর্বমোট ৩৩টি চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে।

কক্সবাজার সহ উপকূলীয় ষোলটি জেলা পড়েছে – উপকূলীয় অঞ্চল হটস্পটে যেখানকার চ্যালেঞ্জগুলি হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, নদী ও উপকূলীয় এলাকার ভাঙন, স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং পরিবেশের অবনমন।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র উচ্চতা বেড়্রে যাওয়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, ঘুর্ণিঝড়ের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া , ঝড় সহ বিভিন্ন দুর্যোগকে আমলে নেওয়া ও এর মাধ্যমে কি ক্ষতি হতে পারে ও এর পরিত্রানের জন্য পরিকল্পনা  সংশ্লিষ্ট হয়েছে এই ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে কক্সবাজার কে র‍্যাংক-১ এ রাখা হয়েছে। সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা র‍্যাংক-১ ও কম দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হচ্ছে র‍্যাংক-৩ এর আওতাভুক্ত। সমুদ্র্যপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, সাইক্লোন, লবণাক্ততা কে এই জেলার ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খরা, জলাবদ্ধতা ও নদী ভাঙ্গন জনিত কারণকে এখানে ঝুঁকি হিসেবে দেখানো হয়নি। মাগুরা, মানিকগঞ্জ এর মত কয়েকটি জেলা শুধু খরা ও বন্যার ঝুঁকি থাকায় সবচেয়ে কম ঝুকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে (র‍্যাংক-৩)। এই র‍্যাংকিং অনুযায়ী সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ (র‍্যাংক -১) ১৬ টি জেলার মধ্যে কক্সবাজার ও আছে। অন্যান্য জেলাগুলি হচ্ছে বাগেরহাট, বরগুনা, ভোলা, চাঁদপুর, ফেনী, গাইবান্ধা, জামালপুর, খুলনা, কুড়িগ্রাম, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, পটুয়াখালি, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও সিরাজগঞ্জ।

সামুদ্রিক ইকো-বৈচিত্র্যের জন্য সোনাদিয়া দ্বীপকে বিশেষভাবে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উপকূল এবং জলজ উদ্ভিদ জীব বৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনার জন্য কক্সবাজার ও হাউড়কে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জলোচ্ছাস থেকে বাঁচার জন্য কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে বহুমুখী বাঁধ নির্মাণে পরিকল্পনার ছোঁয়া আছে ডেল্টা প্ল্যানে। এছাড়া বাকখালি ও মাতামুহুরি নদী ব্যবস্থাপনার উপর জোরদার করার পাশাপাশি উপকুলীয় অঞ্চলে কৃষি-আবাদ ও চিংড়ি চাষাবাদকে জোর দেওয়া হয়েছে।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নের জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থায়ন সম্বলিত বাংলাদেশ ডেল্টা তহবিল গঠন করা হবে। এর মধ্যে ২ শতাংশ নতুন বিনিয়োগ এবং শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় করা হবে। জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ সরকারি তহবিল হতে এবং শতকরা ২০ ভাগ বেসরকারি খাত থেকে আসবে। সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) মডেলে এই শতবর্ষী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে।

সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনার ফল যে কত মধুর তার প্রমাণ ইউরোপের নেদারল্যান্ড যে দেশটি বলতে গেলে অর্ধেকটাই সমুদ্র লেভেলের নীচে এবং অধিকাংশ এলাকা বন্যা প্রবণ (ছিল)।

১৯৫৩ সালের ভয়াবহ বন্যায় এ দেশে মারা যায় প্রায় ১৮০০ জন, তখনই তাদের সরকার পলিসি নেয় “never again” যার ফলশ্রুতিতে তারা পানি প্রকৌশল, ব্যাপক নদী-ড্রেইন, পানি সংগ্রহ-বিস্তৃত সহ বিজ্ঞানসম্মত অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। ডেক, ড্রাম আর প্রাচীর দিয়ে তারা পানি ব্যবস্থাপনাকে অন্য এক বিশাল উচ্চতায় নিয়ে গেছে । দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়, নেদারল্যান্ডকে তাই অনুকরণীয় ভাবে পুরো বিশ্ব।

কথিত আছে এবং বাস্তবতা হচ্ছে, নেদারল্যান্ডে আগামী ১০০০০ বছরেও বন্যা হবেনা।

আশার কথা হচ্ছে, নেদারল্যান্ড ডেল্টা-প্ল্যান বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে পরামর্শ দিচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি বাড়ছে ও মূল্যস্পীতি রয়েছে নিয়ন্ত্রণে। সামাজিক খাতে ও অগ্রগতি হচ্ছে। তবে এসব অর্জন টেকসই হবে কিনা— তা নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে। এর পেছনে অন্যতম মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের সেই প্রভাবকে মোকাবিলা করে দেশকে কিভাবে উন্নয়নের সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত পরিকল্পনা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পন ‘ বা ‘ডেল্টা প্ল্যান’।

একশ বছরের এই ঐতিহাসিক পরিকল্পনাটি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম গত সাড়ে তিন বছরে তার দক্ষ দল নিয়ে গড়ে তুলেছেন যা অনুমোদিত হয়েছে।

শতবর্ষের পরিকল্পনায় কক্সবাজারের উন্নয়নকে অবাধ রাখার জন্য পরিকল্পিত কর্মপরিকল্পনা সংযুক্ত করা হয়েছে এই ডেল্টা প্ল্যানে। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরা বদ্বীপ বা ডেল্টা পরিকল্পনার কৌশলগুলো নির্ধারণ করেছেন।

নিরাপদ কক্সবাজার সহ সারা বাংলাদেশের সমৃদ্ধি প্রত্যাশায় আমরা শতবর্শী এই পরিকল্পনার দুর্নীতিমুক্ত সফলতা কামনা করি।

মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

mmtanim@gmail.com